বঙ্গবাণী কবিতা
বঙ্গবাণী কবিতার মূল্যায়ন

কবি-পরিচিতি:

বঙ্গবাণী কবিতার আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব মূল্যায়ন- আনুমানিক ১৬২০ খ্রিঃ পুর্তগীজ শাসনাধীন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সুধারামপুর গ্রামে আবদুল হাকিম জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান কবি আবদুল হাকিমের স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি ছিল অটুট ও অপরিসীম প্রেম। সেই যুগে মাতৃভাষার প্রতি এমন গভীর ভালোবাসার নিদর্শন ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কালজয়ী আদর্শ। নূরনামা তাঁর বিখ্রাত কাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্য হলোঃ ইউসুফ জোলেখা, লালমতি, সয়ফুলমুলক, শিহাবুদ্দিননামা, নসীহৎনামা, কারবালা ও শহরনামা। তাঁর কবিতায় অনুপম ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে। তিনি ১৬৯০ সালে মৃত্যবরণ করেন।

বঙ্গবাণী কবিতা

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।

সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।

তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।

নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।

আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।

দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।

আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।

 যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।

সেই দেশে সেই বাক্য কহে নরগণ।

সেই বাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।।

বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।

মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।

হিন্দুর অক্ষরে হিংসে সে সবের গণ।।

যে সবে বঙ্গেত জন্মি সিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।

নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।

মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

শব্দার্থ ও টীকাঃ

হাবিলাষ অর্থ- অভিলাষ, প্রবল ইচ্ছা।

ছিফত অর্থ– গুণ।

নিরঞ্জন অর্থ- নির্মল (এখানে সৃস্টিকর্তা, আল্লাহ)

বঙ্গবাণী অর্থ- বাংলা ভাষা।

মারফত অর্থ– মরমি সাধনা, আল্লাহকে সম্যকভাবে জানার জন্য সাধনা।

জুয়ায় অর্থ– যোগায়।

ভাগ অর্থ- ভাগ্য।

দেশী ভাষা যার মনে ন জুয়ায় অর্থ- এই কবিতাটি সপ্তধশ শতকে রচিত। তৎকালেও এক শ্রেণির লোক নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, এমনকি নিজের আসল পরিচয় সর্ম্পকেও ছিল বিভ্রান্ত এবং সংকীর্ণচেতা। শিকড়হীন পরগাছা স্বভাবের এসব লোকের প্রতি কবি তীব্র ক্ষোভে বলিষ্ঠ বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন।

আপে অর্থ- স্বয়ং আপনি।

পাঠ- পরিচিতি

‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি কবি আবদুল হাকিমের নূরনামা কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। মধ্যযুগীয় পরিবেশে বঙ্গভাষী এবং বঙ্গভাষার প্রতি এমন বলিষ্ট বাণীবদ্ধ কবিতার নিদর্শন দুর্লভ।

কবি এই কবিতায় তাঁর গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। আরবি ফারসি ভাষার প্রতি কবির মোটেই বিদ্বেষ নেই। এ সব ভাষায় আল্লাহ ও মহানবীর স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। তাই এসব ভাষার প্রতি সবাই পরম শ্রদ্ধাশীল। সে সব ভাষাভাষী লোকের পক্ষে মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কবির মতে, মানুষ মাত্রই নিজ ভাষায় স্রষ্টাকে ডাকে আর স্রষ্টাও মানুষের কথা বুঝতে পারেন। কবির চিত্তে তীব্র ক্ষোভ এজন্য যে, যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমতা নেই, তাদের বংশ ও পরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে। কবি সখেদে বলেছেন, এ সব লোক যাদের মনে স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি কোন অনুরাগ নেই তারা কেন এদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় না। বংশানুক্রমে বাংলাদেশেই আমাদের বসতি, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা বাংলায় বর্ণিত বক্তব্য আমাদের মর্ম স্পর্শ করে। এই ভাষার চেয়ে হিতকর আর কী হতে পারে। কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় ফুটে উঠেছে।

কবি আবদুল হাকিমের মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনার কারণ

সেই শাসনামলে রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। সে সময় কিছু ব্যক্তিবর্গ তাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে আরবি ফারসি ভাষার প্রতি মনোনিবেশ করতে থাকে। তাঁরা মনে করতো কোরআন-হাদিসের ভাষা যেহেতু আরবি সেহেতু আরবি-ফারসি ভাষা ছাড়া আল্লাহ রাসুলের সান্নিধ্য লাভ হবে না। এছাড়াও প্রাচীন অধিবাসী ছিল হিন্দু । তাদের ভাষা ছিল বাংলা। এই বাংলা বর্ণমালাগুলো ব্রাহ্মলিপি থেকে এসেছে, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের তৈরি হয়েছিল। তার কারণে ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু লোক মুসলমান হয়ে এ ভাষাকে বাদ দিতে চায়। এর কারনে কবি আবদুল হাকিম বঙ্গবাণী কবিতা মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন।

মাতৃভাষা-বিদ্বেষীদের প্রতি কবির মনোভাব।

কবি আবদুল হাকীম ছিলেন মধ্যযুগের কবি। সেই সময় মুসলিম সমাজ বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কবি এই মুসলিম সমাজের ভ্রান্তি বুজতে পেরেছিলেন। বঙ্গবাণী কবিতায় কবি এই ভ্রান্তির কথাই তুলে ধরেছেন। বঙ্গবাণী কবিতায় কবি মাতৃভাষা ও স্বদেশের গুণগান গেয়েছে। কবির মতে, মানুষ যে ভাষায় স্রষ্টাকে ডাকুক না কেন স্রষ্টা তার ভাষা বুঝতে পারেন। কবির ক্ষোভ এই জন্যই যে, যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমতা নেই, তাদের বংশ ও পরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে।

বিভিন্ন দৃষ্টান্ত উপস্থাপনঃ

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা ভাষার এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার ও অধিকার আদায় করা। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা। যা সকল সরকারি-বেসরকারি, অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করা। আর এজন্য বাংলা ভাষা আন্দোলনের মূল স্লোগন ছিল- “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।

বাংলা ভাষায় বর্ণ অশুদ্ধি ও অপব্যবহারের নৈরাজ্য চলছে। তাতে কেবল বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলাই প্রকাশ পায় না, বরং ভাষার নিয়মশৃঙ্খলা সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখা দেয়। বাংলা ভাষা ৩টি অশুদ্ধি কারণে ঘটে থাকে-

(১) উচ্চরণ দোষে

(২) শব্দ গঠন ক্রটিতে এবং

(৩) শব্দের অর্থগত বিভ্রান্তিতে।

বহুবচনের দ্বিত ব্যবহার, দোষ, বিশেষ্য ও বিশেষণ বিষয়ে ধারণা না থাকা, শব্দের গঠনগত অশুদ্ধি, শব্দকে প্রয়োজন ছাড়া নারীবাচক করা ইত্যাদি কারনেই শব্দের অপপ্রয়োগ ঘটে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীরা অজ্ঞতার কারণেই ঘটে থাকে অপপ্রয়োগের ঘটনা। যারা লেখক তাদের এক্ষেত্রে সচেতনতা অত্যান্ত জরুরি। কারন, তার লেখা পাঠ করে অনেক মানুষ প্রভাবিত হয়। প্রভাবিত হয় স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। আবার অনেকেই বলেন, অর্থ বুঝলেই হলো। শুদ্ধি ও অশুদ্ধি নিয়ে এত বিতর্কের কী দরকার?

আমরা বলার সময় যেভাবেই বলি না কেন, লেখার সময় অবশ্যই সঠিক লেখতে হবে। নিম্নে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টিকে আমরা উপস্থাপন করতে পারি-

(১) বহুবচনের দ্বিত্বজণিত ভূলঃ অনেকেই আমরা অশুদ্ধভাবে বহুবচনের দ্বিত্ব ব্যবহার করে থাকি। যেমন: সার্কভূক্ত অন্যান্য দেশগুলো, নিম্নলিখিত সব শিক্ষার্থীগণ,  এরকম বহুবচনের দ্বিত্বজনিত অপপ্রয়োগ চোঁখে পড়ে। উপরের এরকম সব দৃষ্টান্তগুলোর শুদ্ধ প্রয়োগ হচ্ছে- ’সার্কভূক্ত অন্যান্য দেশ’, অথবা হতে পারে ‘সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলো’, ’নিম্নলিখিত সব শিক্ষার্থী’ অথবা নিম্নলিখিত শিক্ষার্থীগণ।

(২) ইং, তাং, নং ইত্যাদি বাঙ্গালি তারিখের পর ইং বলে একটা চিহ্ন লিখে থাকি। তারিখ, নম্বর এসব শব্দকেও লেখা হয় তাং, নং রূপে। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। তবে এসব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু কেন কিভাবে এমন হলো? মনে রাখতে হবে সংক্ষেপে এই ( . ) একটা চিহ্ন হলো বিরাম। তারিখ লেখার পর ইং লেখি ইংরেজি সাল বলে। প্রথিবীতে ইংরেজি সাল বলে তো কোন সাল নেই, তাই এর প্রশ্নই আসে না। একটা অপপ্রয়োগের ফলে সম্পূর্ণ বাংলাভাষী অনগোষ্ঠীই আক্রান্ত। এমনকি টিভি, সংবাদ পত্রিকা, ইত্যাদিতেও ইংরেজি নবর্ষের শুভেচ্ছা অপপ্রয়োগ করা হয়।

(৩) প্রেক্ষিতঃ পরিপ্রেক্ষিত অর্থে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় প্রেক্ষিত শব্দটি। লেখাই বাহুল্য যে, এটি ভূল প্রয়োগ। প্রেক্ষিত শব্দটি এসেছে প্রেক্ষণ শব্দ থেকে। প্রেক্ষণ হলো বিশেষ্য পদ, যার অর্থ দৃষ্টি। আর এ থেকেই তৈরি হয়েছে বিশেষণ পদ প্রেক্ষিত।

মাতৃভাষায় রক্ষার্থে পরিকল্পনা

আমাদের বাংলা ভাষা মাতৃভাষার অপপ্রয়োগ কমাতে এবং যথাযথ প্রয়োগ ব্যবহার বাড়াতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলির উপর ব্যবস্থা বাড়াতে হবে:

১। বাংলার শব্দভান্ডার উন্নত করা

২। বাংলা একাডেমীকে আরও উন্নত ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা

৩। জাতীয় শিক্ষাীতিকে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে বাধ্য করা

৪। ব্যাকরণগত শব্দকে সহজবোধ্যতায় আনা

৫। গণমাধ্যমগুলিকে ভাষা ব্যবহারে আরও সচেতন হওয়া

৬। বিভিন্ন মিডিয়াতে যেমন: নাটক, সিনেমা ইত্যাদি সঠিক মাতৃভাষা প্রয়োগ করা।

৭। বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে ব্যবস্থা নেয়া।

৮। বাংলা ভাষার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সচেতনতা বাড়ানো।

৯। শিক্ষকদের শুদ্ধ উচ্চারণ করা।

এই বিষয়ে ভিডিওঃ

অ্যাসাইনমেন্ট কাভার পেজ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করো।

x